সময়টা ২০০১ সাল।তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান বিচারপতি লতিফুর রহমানের অধীনে বাংলাদেশের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচন কার্যক্রম চলছে।ভোলা-১,২ ও ৩ নং আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী জনাব তোফায়েল অাহমেদ।
লতিফুর রহমান দায়িত্ব নেয়ার পর হতেই ক্ষমতার দিব্য আশীর্বাদে অনেক বলীয়ান বিএনপি।ভোলা-২ আসনে বিএনপি প্রার্থী হাফিজ ইব্রাহীম।যে কোন উপায়েই হোক তাকে জয়লাভ করতে হবে।
বিগত আওয়ামী লীগ ক্ষমতামলের সুবিধাভোগী আওয়ামী লীগ নেতা কর্মীর কেউ কেউ বিএনপিতে যোগদান করে।আবার অনেকেই বিএনপির সঙ্গে আতাত করে।২০০৯ সাল হতে টানা ১১ বছর অাওয়ামী লীগের ক্ষমতামলে দৌলতখানে প্রভাবশালী নেতা হিসেবে যাদেরকে এখন অাখ্যায়িত করা হয়।২০০১ সালের নির্বাচনে এরা ছিলেন বিশ্বাসঘাতক।দলের সঙ্গে বেঈমানী করে,দৌলতখান বিএনপির ক্যাডার বাহিনীর আস্তানা ও অস্ত্রাগার হিসেবে খ্যাত খেলোয়াড় ঐক্য পরিষদে যাতায়াত করতেন।আবার বিএনপি প্রার্থীর নিকট হতে টাকাও গ্রহণ করেন।
একেবারেই ব্যতিক্রম ছিল ছোট ভাই ইমাম হোসেন।ইমাম হোসেন মুজিব অাদর্শের চেতনায় উজ্জীবিত।কয়েক বছরের পরিশ্রম,সাংগঠনিক দক্ষতায় সে গড়ে তোলে মুজিব সেনা সংঘ। সংগঠনটির অফিস ছিল দৌলতখান বাজার হতে অনতিদূরে ভবানীপুর চেয়ারম্যান বাজার।ইমাম হোসেন সংগঠনের সভাপতি।ইমাম হোসেনের উদারতা ও ভালবাসার কারণে তার সাংগঠনিক ব্যাপ্তি অনেক দূর ছড়িয়ে পড়ে।সংগঠনের সদস্য সংখ্যা প্রায় ছয়শত।
তারুণ্যনির্ভর বিশাল কর্মী বাহিনী নিয়েই বিএনপির সুসজ্জিত বাহিনীকে মোকাবেলা করে ইমাম হোসেন।বিএনপির পক্ষে ঢাকার অনেক বাহিনীর সঙ্গে,স্হানীয় বাহিনীও সুসজ্জিত হয়ে মরণকামড় দিয়ে মাঠে ঝাঁপিয়ে পড়ে।ভীতিকর পরিস্হিতিতে আওয়ামী লীগের প্রচার কার্যক্রমও স্হবির হয়ে পড়ে।এসময়ে দৌলতখানে আওয়ামী লীগের ত্রাতা হিসেবেই আবির্ভূত হয় ইমাম হোসেন নামক এক উজ্জলতর নক্ষত্র কালপুরুষের।
এই কালপুরুষ দলীয় আদর্শিক চেতনায় উদ্ভুদ্ধ হয়ে বিএনপির বাহিনীগুলোর সঙ্গে ইঞ্চি ইঞ্চি লড়াই চালিয়ে গেছেন।বিএনপি প্রার্থীর পক্ষ হতে বড় অঙ্কের টাকার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে মাঠের লড়াইয়ে অারও দৃঢ়চেতা হয়ে ওঠে।আওয়ামী লীগ প্রার্থী জনাব তোফায়েল আহমেদ আক্ষেপ করেই আমাকে বলেছিলেন-তোদের পরিবার,আর গুটিকয়েক নেতাকর্মী ব্যতীত অধিকাংশ দলীয় কর্মীরাই আমার সঙ্গে বেঈমানী করছে।আমি দৌলতখানে অাসলে ওরা আমার পাশ আগলে থাকে আর চলে যাওয়ার পরই বিএনপির সঙ্গে আতাত করে।
বিএনপি বড় অঙ্কের টাকার প্রলোভনে ইমাম হোসেনকে লড়াইয়ের পথ হতে সরাতে না পেরে,তাকে হত্যা অথবা সেনাবাহিনীকে দিয়ে গ্রেফতারের পরিকল্পনা করে।২৩ সেপ্টেম্বর ২০০১ রাতে ভবানীপুর চেয়ারম্যান বাজারে বিএনপির বিশাল বাহিনী দ্বারা ইমাম হোসেন ও তার দল অাক্রান্ত হয়।সন্ধ্যার পর হতে মধ্যরাত পর্যন্ত চলে ভয়াবহ সংঘর্ষ,অবশেষে ইমাম হোসেনের বাহিনীর কাছে মার খেয়ে মধ্যরাতে বিএনপির বাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়।লড়াই শেষে ইমাম হোসেন দক্ষিণ ভবানীপুর আমার বড় ভাই আওলাদ হোসেনের বাড়িতে গিয়ে ঘুমায়।
নির্বাচনকালীন পুরো সময়েই সে রাতে স্হান পরিবর্তন করতো,তারই ধারাবাহিকতায় সেই রাতেও সে দক্ষিণ ভবানীপুর বড় ভাইয়ের বাড়ি ত্যাগ করে আমার ছোট চাচার বাড়িতে চলে আসে।কিন্তু বিএনপির নিয়োগকৃত সোর্স তাকে নজরে রাখে।খুব সকালেই সেনাবাহিনী ইমাম হোসেনকে গ্রেফতার অভিযান চালায়।বিএনপি কর্মীদের প্রদর্শিত পথেই সেনাবাহিনী তাদের লক্ষ্যস্হলে পৌঁছে যায়।গ্রেফতার হলেন ইমাম হোসেন,সেনাবাহিনী তার ওপর বর্বরোচিত নির্যাতন চালায়।শরীর থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত ঝড়ে পড়ে মাটিতে।তার রক্তে ভেজা মাটি রঙিন হয়ে ওঠে।তাকে গ্রেফতারের পর দৌলতখান থানায় এবং পরবর্তীতে ভোলা সদর কারাগারে প্রেরণ করা হয়।তৎকালীন উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি মোঃ নজরুল ইসলাম ভোলা সদরে গিয়ে তার তাৎক্ষণিক চিকিৎসার ব্যবস্হা করায়।
নির্বাচনে বিএনপি জয়লাভ করার পর,তার নামে দায়েরকৃত মামলার ফিরিস্তি দেখে রীতিমতো বিস্মিত হই।মামলার সংখ্যা মোট ১৭টি।তাকে দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ে মামলা হতে মুক্ত করতে নতুন করে আমার সংগ্রাম শুরু হয়।মামলায় জনাব নজরুল ইসলাম ব্যতীত আর কোন নেতা বা পারিবারিক সদস্যের অার্থিক সহযোগিতা পাওয়া যায়নি।ইমাম হোসেন ছয় বছর পনের দিন কারাভোগ করে,তাকে কারাগার হতে মুক্ত করা পর্যন্ত আমার দশ লক্ষাধিক টাকা ব্যয় হয়।
২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয় আমাদের মধ্যে অনেক প্রত্যাশাই দানা বেঁধে ওঠে।সময়ের পরিক্রমায় দৃশ্যমান হল-আমরা সম্পূর্ণভাবেই উপেক্ষিত।দৌলতখানে নিয়ন্ত্রকের অাসনে উপবিষ্ট ২০০১ সালের নির্বাচনে দলের সঙ্গে যারা বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন।
দীর্ঘ ১১ বছর আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন,অথচ ইমাম হোসেন দল হতে কখনো দশটি টাকাও পায়নি।ক্রমান্বয়ে তার বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শরীরে নানারুপ সমস্যা দেখা দিয়েছে।সেনাবাহিনীর নির্যাতন,কারাগারে থাকাকালীন পায়ে ১৮ কেজি ওজনের ডান্ডাবেরী পরিহিত থাকায়,এখন তার পায়ের অনেক টিস্যু শুকিয়ে গেছে।মেরুদণ্ডের হাড়,কোমরের জয়েন্টের লালা শুকিয়ে ধীরে ধীরে শরীর অচল হয়ে আসছে। সমগ্র শরীরে তীব্র যন্ত্রণা ও ব্যাথায় কাতড়াতে থাকে।
বিগত জুন মাসের শেষের দিকে তাকে ঢাকাতে এনে চিকিৎসা করাই।তার চিকিৎসায় আমাদের অনেক টাকা ব্যয় হয়।২ জুলাই তাকে নিয়ে ফেসবুকে একটি প্রতিবেদন দেয়ার কয়েকদিন পর জানতে পারি ভোলা-২ আসনের মাননীয় সংসদ সদস্য তার সকল চিকিৎসার দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন।
ইমাম ঢাকাতে চিকিৎসায় কিছুটা সুস্হবোধ করলে তাকে বাড়ি পাঠিয়ে দেই।সে বাড়িতে পৌঁছার কয়েকদিন পর মাননীয় সংসদ সদস্য দৌলতখানে গেলে ইমাম হোসেন তাঁর সঙ্গে দেখা করে।কিন্তু কিভাবে কী দায়িত্ব তিনি গ্রহণ করেছেন,তা ইমাম হোসেনের নিকট স্পষ্ট হয়নি।
আমার বড় ভাই ক’দিন অাগে ফেসবুকে লিখেছেন এমপি সাহেব ইমামের চিকিৎসার দায়িত্ব নিয়েছেন।কিন্তু কিভাবে দায়িত্ব নিলেন,কেমন দায়িত্ব নিলেন তা আমরা বুঝতে পারিনি!
ইমাম হোসেন যে ডাক্তারের অধীনে চিকিৎসাধীন রয়েছে সেই ডাক্তারের পরামর্শেই তার চিকিৎসা চালাবো,নতুন করে অন্য কোন ডাক্তারের মাধ্যমে তার চিকিৎসা করানোটা আমাদের নিকট যৌক্তিক মনে হয়নি।
ইমামের শারিরীক অবস্হার আবারো মারাত্মক অবনতি হয়েছে।সে রীতিমতো বিছানা হতে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে না।তাকে আবারো ঢাকাতে আসতে বলেছি,ঈদ-উল-আজহার পর আবারো সে ঢাকাতে আসবে।যে ডাক্তারের চিকিৎসায় কিছুটা সুস্হবোধ করেছিল,আবারো তাকে দেখিয়ে,তাঁর পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা করাবো।মাননীয় সংসদ সদস্য ভোলা-২ তার চিকিৎসার কী দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন,তা স্পষ্ট বুঝতে পারলে কৃতার্থ হবো।