সত্যের খোঁজে আমরা
আর সাচ্চু ভাইয়া বরিশাল যাচ্ছি। বরিশাল বেড়াতে যাওয়া বরাবর আনন্দের। অবিরত জলের রাশি কেটে এগিয়ে যাওয়া। ঢাকা-বরিশাল রুটে তখন আজকের মতো অত বিশাল লঞ্চ চলত না। লঞ্চ মানেই কাঠের তৈরি ছোট নৌযান। বড় লঞ্চ বলতে এমভি ছামাদ—হ্যাঁ বানানাটা ছামাদ। প্রমিত বানানে সামাদ নয়।
ছামাদ আদতে ছিলো কোস্টাল লাইট ক্যারিয়ার। পরে ঢাকা-বরিশাল রুটে নামানো হয়। নদীগুলো তখন ছিল জলে ভরপুর। আজকের মতো শীর্ণকায়া নয়। চাঁদপুর পেরিয়ে তো নদীর পাড় দেখার উপায়ই ছিলো না। অত বিস্তৃত ছিলো নদী। দশ-পনের মাইল চওড়া তো হবেই। চারদিকে শুধু পানি আর পানি। আর ঢেউ। তিন-চার ফুট উঁচু এক একটি। বাতাস থাকলে তো কথাই নেই।
উত্তাল সে জল ঠেলে এগিয়ে যেত ক্ষুদ্রকায় যানগুলো। যাত্রাপথে কিন্ত বিলাসী ভ্রমণের ছোঁয়া ছিল না। কেবিন ছিল না কোন লঞ্চে। রাজহংস আর ছামাদে ছিলো কেবিন। তাও চার-পাঁচটির বেশী নয়। ডেকে চাদর বিছিয়ে শুয়ে বসেই যেত সবাই। সকাল এগারটার দিকে সদরঘাটে যাওয়া। গিয়ে চাদর বিছিয়ে আসা। ওটাই রিজার্ভেশন। আগাম টিকেট কাঁটার বালাই ছিলো না। মাগরেবের আগে গিয়ে উঠে বসা। লঞ্চ ছাড়ত সন্ধ্যা ছটায়। ভোর সকালে বরিশাল।
ব্যতিক্রম ছিল দিনে চলা সরকারী এই স্টিমারগুলো। তিনটি স্টিমার চলত তখনঃ স্টার্ন, লেপচা, আর শহীদ। ছাড়ত সকাল দশটায়, বাদামতলী ঘাট থেকে। সদরঘাট থেকেও যাত্রী তুলত। রওনা দিত এগারটায়। জল কেটে সারাদিন চলে বরিশাল। পৌঁছতে পৌঁছতে রাত নটা কি দশ। কখনো দেরী হলে এগার-বারটাও হতো। সপ্তাহে তিনদিন ছিল শিডিউল। আশির দশকেও বরিশালবাসীর রাতের টাইম টেবিল ঠিক হতো ঘাটে পৌঁছা স্টিমারের জলদগম্ভীর হুইসেলে। সে সব দিনের কথা আজ রূপকথার মতো শোনাবে।
যাত্রায় অনেকে স্টিমার পছন্দ করতেন। বিশেষকরে, ঝড়-বাদলের মৌসুমে। অমন নিরাপদ বাহন আর হতে পারে না। আমি নিজেই সাক্ষী। চরম ঝড়েও মেঘনার বুকে ফুঁসে ওঠা ফেনিল উত্তাল জলে নির্বিকার চলছে স্টিমার। কোন বালাই বা বিকার নেই। যাত্রীদেরও নির্লিপ্ত ভাব। স্টিমারের আরেক আনন্দ এর খাওয়া-দাওয়ার বহর। কেবিন যাত্রীদের ছিলো এংলো ও দেশী খাবারের পদ। মচমচে পটেটো ওয়েজ। সাথে ভূনা খিচূড়ী। কশা মুরগীর গোশত। রসে টইটম্বুর লেবু, কাঁচা-লঙ্কা আর আচার। চাইলে রোস্ট-পোলাও-ও পাওয়া যেত। তবে ভূনা খিচুড়ী ছিল তুলনারহিত। ওটাই অধিকাংশ যাত্রী খেতো। বিকেলে চিকেন কাটলেট। সারাদিন টুকটাক এটা সেটা তো আছেই। চানাচুর, মুড়িমাখা, বুট, বাদাম, শশা-খিরা। আরও কত কি!
আশির দশকের শেষেই স্টিমারগুলোর সার্ভিস বন্ধ হয়ে আসে। উঠে যেতে থাকে একে একে। তিনটিই ছিলো ১৯৯২ থেকে ১৯৩২ সালের তৈরি। ফলে প্রায়ই বিকল হতো ইঞ্জিন। ওদিকে বিলাসবহুল লঞ্চ ততদিনে রুটে এসে গেছে। সরকারও যানগুলো তুলে নেয়। বাদামতলীর কাছে নোঙর করে রাখে। অথচ, স্টিম প্যাডেল স্টিমারগুলো কিন্তু রিনোভেট করে ফের নামানো যায়।
বাংলাদেশে এখন ট্যুরিজম ডেভেলপ করেছে। আমাদের কালে তো সে ধারণা ছিলো না। বেড়াতে যেত মানুষ কাজে বা দরকারে। উঠত পরিচিতের বাসায়। হোটেলে ওঠার চল ছিল না। ঘোরাঘুরির ধারনাও ছিল না। এখন যেমনটা হয়েছে। তাই বলছি, পর্যটনের জন্যে এগুলো এখন হতে পারে অর্থকরী। আগের মতো ঢাকা-খুলনা ভায়া বরিশাল-ঝালকাঠি-পিরোজপুর রুটে চালালে আমি নিশ্চিত, প্রচুর পর্যটক পাওয়া যাবে।
খানাদানা সমৃদ্ধ আটচল্লিশ ঘণ্টার আলস্য ভরা অমন রিল্যাক্স ভ্রমণ আর হয় না। বেসরকারী প্রতিষ্ঠানও এগিয়ে আসতে পারে। বিদেশী ট্যুরিস্টও মিলবে প্রচুর, বিশেষকরে, শীতের মৌসুমে। সাধারণ যাত্রীর কথা আর নাই বলি। গভীর রাতে, ঘুমের অবচেতনে যাঁদের বুকে স্টিমারের হুইসেল এখনও ঘাই মারে, ফেলে আসা শৈশব স্মৃতি কড়া নাড়ে, তারা কী না উঠে পারে?
মিসিসিপি নদীতে এখনও প্যাডেল স্টিমার আছে। মিসৌরীর সেন্ট লুইসে আমি নিজে উঠেছি। বাংলাদেশে চলতে অসুবিধে কোথায়?