এক যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা –নেই সনদ, পাইনা কোন ভাতা

এক যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা –
নেই সনদ, পাইনা কোন ভাতা


মোঃ রফিক ভূঁইয়া খোকা
(ময়মনসিংহ)

মোঃ দুলাল উদ্দিন(৭৫) ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার চরআধপাখিয়ার করমুল্ল্যাপুর নিবাসী এক হতভাগা যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার নাম। তিনি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠন ও মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতায় নিয়োজিত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে জড়িত থাকা অবস্থায় তার বুকে গুলি করা হয় যার দাগ এখনো তার বুকে বিদ্যমান আছে। বর্তমানে তিনি কোন কাজ করতে পারেননা। তার নেই কোন ছেলে সন্তান। দুটি মেয়ে ও নাতনিদের নিয়ে খেয়ে না খেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করিতেছেন তিনি। নকল মুক্তিযোদ্ধা সনদের ছড়াছড়ি আর দারিদ্রতার দরুন প্রমাণের অপেক্ষায় এখনো অবহেলায় পড়ে আছে ৭১-এ মুক্তিযুদ্ধে গুলিবিদ্ধ হয়েও সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধা দুলাল উদ্দিন। বৃহত্তর ময়মনসিংহের জীবন্ত কিংবদন্তী, অতি দরদী মনের বীর মুক্তিযোদ্ধা বীরবিক্রম হায়দার আলীর মাধ্যমে তার সাথে কথা বলে জানা যায়, অনেক ঘুরাঘুরি করে, অনেকের কাছে গিয়েও কার্যত কেউ কোন কাজ করে দেয়নি তার জন্য। তিনি বলেন, যাদের সাথে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি তাদের অনেকেই এখনো জীবিত আছেন যারা আমার স্বাক্ষী। তিনি আরো বলেন, আমার আসল প্রমাণ দেশের জন্য গুলি খাওয়া আমার বুকের মধ্যে সেই গুলির দাগ যা এখনো দৃশ্যমান। বড় দুঃখ, তারপরও আমার নেই কোন স্বীকৃতি, নেই কোন সনদ, পাইনা কোন ভাতা ও সুযোগসুবিধা। এরপরই তিনি বলতে থাকেন তার যুদ্ধের কাহিনী অশ্রুবিগলিত কণ্ঠে- ১৯৭১ সাল। ঢাকার মালিবাগে থাকে আমার এলাকার এক লোক। তিনি বিমানবন্দরে চাকরি করতেন। তার ফুল বাগানে শ্রমিক হিসেবে সেখানে কাজ করি। শুনলাম, ৭ তারিখ রেসকোর্স ময়দানে নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ভাষণ দিবেন। ভাবলাম, বঙ্গবন্ধুর কথা শুনতে পারব কাছ থেকে- সেতো অনেক বড় কপাল আমার। তারপর সেদিন সেখানে যাই এবং বক্তব্য শুনে নেতার কথামতো নিজ এলাকায় ফিরে আসি। মুজিবুর বলেছেন, “যুদ্ধ করতে হবে পাকিস্তানের বিপক্ষে, আমাদের ন্যায্য অধিকার আদায় করতে হবে, দেশ স্বাধীন হবে, এলাকায় এলাকায় লোক যোগাড় করেন, একত্রিত হন।” সেখান থেকে ঐদিন রাতেই বাড়ি ফিরে আসি। আমি এলাকায় প্রায় সকল লোকের কাছে শেখ সাহেবের ভাষণের কথা বলি ও সকলকে মুক্তিযুদ্ধের জন্য একত্রিত করার চেষ্টা করি। এমনকি তাদেরকে নিয়ে একাধিকবার বৈঠকও করি। তারপর যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে কোন এক সন্ধ্যায় আমাদের বাড়ী একদল মুক্তিযোদ্ধা আশ্রয় নিলে আমার মরহুম চাচার হুকুমে আমি তাদেরকে খিচুরির ব্যবস্থা করে খাবার দেই। পরে তাদের সাহায্যে তাদের কাপড় ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসের একটা বড় পুটলি মাথায় বহন করে তাদেরকে বেগুনবাড়ি, ময়মনসিংহ সদর পর্যন্ত গিয়ে পথ দেখাই ও তাদের পরামর্শে পুনরায় চুপিচুপি রাজাকার ও পাকবাহিনীর নজর আড়াল করে বাড়ী ফিরে আসি। কিন্তু এভাবে ধীরেধীরে মুক্তিযুদ্ধে আমার সমর্থন, সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড ও মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করা রাজাকারদের কাছে খবর পৌঁছে যায় ও প্রকাশ হয়ে যায়। রাজাকার মৃত মধু নামে মুক্তাগাছার লেংড়াবাজার বাসী একজন আমাকে আমার নিজ বাড়ি থেকে ডেকে নেয় ও পাকবাহিনীর হাতে তুলে দেয়। তখন পাকসেনাদের কাছে মধু অভিযোগ করে যে, দুলাল একজন মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করে, শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সকলকে যুদ্ধে অংশগ্রহণ ও লোকজন সংগ্রহের কাজ করে। তারপর পদুরবাড়ী, জামালপুর মেইন রাস্তা সংলগ্ন স্থানে আমাকে ও আমার সাথে নিয়ে আসা আমার বড় ভাই মোঃ হেলাল উদ্দিনকে সেখানে নিয়ে গিয়ে গুলি করে। আমার সেই ভাই তখনই মারা যায়। উল্লেখ থাকে যে, আমার শহীদ হওয়া সেই বড় ভাইয়েরও কোন সনদ নেই এবং তার জীবিত স্ত্রী এখনো কোন ভাতা বা সুযোগসুবিধা পায়না। আর আমি গুলিবিদ্ধ হয়ে সেখানেই পড়ে থাকলে পাকসেনারা মৃত ভেবে আমাকে সেখানে রেখে চলে যায়। তখন আমি হামাগুড়ি দিয়ে কাছেই পদুরবাড়ী যতিন ঠাকুরের বাড়ি গিয়ে ওঠি। সেখানকার এক জঙ্গল থেকে আজগর নামে এক ব্যক্তি যিনি এখনো বেঁচে আছেন আমাকে ছোট চকিতে বহন করে নিয়ে আসেন আমার বাড়ি। নিজ বাড়িতেও জঙ্গলে থেকেই গোপনে চিকিৎসা করা হয় আমার। তারপর সেই সময় থেকে আজ পর্যন্ত যুদ্ধাহত হয়ে এখনো বেঁচে আছি আল্লাহর অশেষ রহমতে। দীর্ঘদিন গুলিবিদ্ধ হয়ে থেকে সুস্থ হয়ে দেখি আমার দেশ বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। মনেমনে সুখ পেলাম, আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক এবং আমাদের নেতা শেখ মুজিব তখনও বেঁচে আছে। আমি একজন মহান নেতার ডাকে মুক্তিযুদ্ধ করতে পেরেছি, আমার নেতাকে নয়মাস যুদ্ধের পরেও জীবিত পেয়েছি, দেখেছি তাঁকে এতেই আমি খুশি। পাশাপাশি বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে শেখের বেটির নিজ হাতের স্বীকৃতি পেলে তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা হয়ে শেখের হাতে গড়া সোনার বাংলার একজন অংশীদার হতে পারলে আরো ধন্য হতাম এবং জীবনের শেষ কটাদিন আরাম-আয়েশে কাটাতে পারতাম। আমি আশা রাখি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমার বিষয়টি সুবিবেচনায় নিবেন ও যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *