:- তা গলাটা এরকম শোনাচ্ছে কেন? (রবীন্দ্রনাথ ঈষৎ বিস্মিত। নজরুল খুবই হুল্লোড়বাজ রগুড়ে মানুষ। আজ তো গলা শোনাই যাচ্ছে না!) কী ব্যাপার, কারোর শরীর-টরীর খারাপ নাকি!
:- সে কী! চমকে উঠলেন রবীন্দ্রনাথ। ঊনসত্তর বছর বয়স তাঁর। এখন কি শুধু খারাপ খবর পাওয়ার জন্যেই বেঁচে থাকা? রবীন্দ্রনাথ মাঝে-মাঝেই একথা ভাবেন। চিকিৎসাশাস্ত্র একেবারেই অনুন্নত। বাঙালী পুরুষের গড় আয়ু মেরেকেটে চল্লিশ। নিজের অদ্ভুত ভালো স্বাস্থ্যের জন্য নিজেরই বিড়ম্বনা লাগে। খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে জিজ্ঞাসা করলেন, কী হয়েছিল?
:- কত বয়স হয়েছিল। তিন, না?
আবার দীর্ঘক্ষণের নীরবতা। বাঙালীর দুই প্রাণের কবি। শব্দের দুই জাদুকর। আজ দুজনেই নীরব। একটু পরে রবীন্দ্রনাথই আবার নীরবতা ভাঙলেন, তোমার ছেলেটি বড় গুণের ছিল শুনেছিলাম। কী যেন নাম রেখেছিলে?
:- হ্যাঁ, বুলবুল, বুলবুল। নিজের মনেই দুবার নামটা আওড়ালেন রবীন্দ্রনাথ। শুনেছিলাম তার নাকি অদ্ভুত স্মৃতিশক্তি।
:- আরে না, সেরকম কিছু না। আমায় মুজফ্ফর আহমেদ বলেছিল। গতবছর জেলে যাবার আগে আমার সঙ্গে দেখা করেছিল। তোমরা তো একসময় মেসে একই ঘরে থাকতে?
:- বলছিল, তোমার ছেলে নাকি শ্রুতিধর!
:- বলো কী!
রবীন্দ্রনাথ কিছু বললেন না। সন্তান হারানোর চেয়ে বড় শোক আর কী আছে। কেঁদে একটু হাল্কা হোক।
:- বাড়ির কী খবর? আবার রবীন্দ্রনাথই নীরবতা ভাঙলেন। এমনিতে নীরবতা তাঁর বড় প্রিয়। কিন্তু আজ যেন বড্ড অস্বস্তিকর লাগছে।
:- রবীন্দ্রনাথ মৃদু হাসলেন। তোমার মনে আছে নজরুল, আজ থেকে দশ-বারো বছর আগে তুমি যখন সেনাবাহিনী ছেড়ে কলকাতায় এলে তখন আমি তোমাকে শান্তিনিকেতন যাবার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম? বলেছিলাম তুমি আমাদের শরীরচর্চা শেখাবে আর প্রাণের খুশিতে গান গাইবে। তুমি রাজি হওনি।
:- পরে কিন্তু আর বলি নি, তাই তো?
:- কেন বলতো?
:- আরে না রে পাগল। সেই জন্য নয়! রবীন্দ্রনাথ হেসে উঠলেন।
:- না হে, না। তোমার গুরুদেবের মন অত সংকীর্ণ নয়। তাহলে তো তোমার-আমার সম্পর্কই কবে খারাপ হয়ে যেত। তাহলে কি আর তোমার লেখা 'বিদ্রোহী' কবিতা পড়ে তোমাকে সকলের সামনে ওরকম জড়িয়ে ধরতে পারতাম? আমি আর কখনো কি কোথাও ওরকম আবেগ প্রকাশ করেছি?
:- করবো না? তুমি তো সরস্বতীর বরপুত্র। কী অপূর্ব তোমার লেখার হাত। তোমাকে ও কথা বললাম। তুমি রাজি হলে না। তারপরে আমি তোমার লেখা পড়েই বুঝেছিলাম তুমি অস্বাভাবিক প্রতিভাবান। শান্তিনিকেতনে গেলে তোমার ট্যালেন্ট একটা ছোট জায়গাতেই আবদ্ধ হয়ে থাকত। কলকাতায় না রইলে তোমাকে এত লোক চিনতো না!
:- বাসিই তো। তুমিও তো প্রথমদিকে খালি আমার গানই গাইতে। তুমি আর তোমার এক বন্ধু তো জুটি বেঁধে সারা বাংলায় আমার গানই গেয়ে বেড়াতে।
:- ও কথা বোলো না। আমাদের দুজনের স্টাইল তো আলাদা। কী চমৎকার শ্যামাসংগীত লেখো তুমি। আমি তো সেরকম কিছু লিখলামই না!
:- তুমি তো প্রচুর গান লেখ। তোমার গানের সংখ্যা তো এখনই আমাকে ছাড়িয়ে গেছে শুনতে পাই।
:- ও হয়ে যায়। প্রকৃতিগত ভাবেই আমি খুব স্বাস্থ্যবান। সামান্য অর্শ ছাড়া আমার আর কোন সমস্যাই নেই।
কথায় বাধা পড়ল।কবিগুরুর বউমা প্রতিমাদেবী এসে জিগ্যেস করলেন, বাবা, আপনি কিছু খাবেন?
:- তুমি কিছু খাবে নাকি, নজরুল?
:- আমিও এখন কিছু খাব না, বউমা।
আপনি এখন খুবই কম খান। মৃদু অনুযোগ জানিয়ে প্রতিমা চলে গেলেন।
:- না গো, বয়স হয়েছে। আমার বাবা বলতেন বেশী যদি খেতে চাও, তো কম কম খাও। তা সত্যি।
আরেকজনও ছিল বুঝলে? সেও আমার গান গাইত। আর খেতে বড় ভালবাসত।
:- কে আবার। বিবেকানন্দ। আমি বলতাম নরেনবাবু। আমরা তো প্রায় সমবয়সী। আমি এক দেড় বছরের বড়।
নজরুল একটু অবাক হলেন। তার কেন জানি ধারণা ছিল রবীন্দ্রনাথ আর বিবেকানন্দের পারস্পরিক সম্পর্ক সেরকম ভাল ছিল না।
:- কী ভাবছ? রবীন্দ্রনাথ যেন মনের কথা পড়তে পারলেন। তুমি জানতে আমাদের আদায় কাঁচকলায়, তাই তো?
নজরুল আর কি বলবেন। অস্বস্তির হাসি হাসলেন।
:- লোকে এসব বলে বেড়ায়। কেউ কিছু জানে না, জানার চেষ্টা করে না।
:- তবে শোন। তখন আমার বয়স বিশ। রাজনারায়ন বসুর মেয়ের বিয়ে। আমাকে জ্যোতিদাদার মাধ্যমে খবর পাঠালেন গান গাইতে হবে। বাল্মিকী প্রতিভা বেরিয়ে গেছে। একটু-আধটু নামও হয়েছে। তবে অত লোকের মধ্যে একা গাইব! একটু টেনশন হচ্ছিল। এইসময় হঠাৎ নরেনবাবুর সঙ্গে দেখা। আমাদের বাড়িতে প্রায়ই আসত। আমার ভাইপোর বন্ধু ছিল। ব্যাস্। ওঁকে চেপে ধরলাম।
:- বেশ কিছুদিন রিহার্সাল করলাম। তিন খানা গান। আমার লেখা। নরেনবাবু গাইল, পাখোয়াজ বাজাল। আমি অরগান বাজালাম।
:- ঐ গলা মেলালাম। নরেনবাবুর গলার সঙ্গে আমি পারি নাকি? কী জোরাল ওজস্বী গলা ছিল!
নজরুল চুপ করে রইলেন।
:- তারপর তো সারা কলকাতায় আমার গান গাইতে লাগল। রেগুলার তাড়া। গান লিখুন, গান লিখুন। আমার গান তো রামকৃষ্ণদেবকেও শুনিয়েছিল। তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা।
:- শোনাই নি মানে? বছরখানেক পরেই তো শোনালাম, কাশী মিত্রের বাগানবাড়িতে। কী খুশি যে হলেন! বড় মধুর স্বভাবের ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ একটু যেন অন্যমনস্ক।
:- তারপর তো রামকৃষ্ণদেব মারা গেলেন। নরেনবাবুও ভ্যানিশ। প্রায় দশ বছর পর হঠাৎ উদয় - বিবেকানন্দ হয়ে। বিশ্বজোড়া নাম। কলকাতায় সম্বর্ধনা দেওয়া হল। আমিও মঞ্চে ছিলাম। চিনতে পারলো, বেশ কথাও হল।
:- ছিলাম তো। কী নায়কোচিত জীবন। যেন নভেল। আমার একটা উপন্যাস তো ওঁকে নিয়েই লেখা না হলেও ওর খানিকটা প্রভাব আছে।
:- কেন, গোরা।
:- আর বিবেকানন্দের আরেক অনুষ্ঠানের তো আমিই ছিলাম প্রধান উদ্যোক্তা। তবে তাতে উনি ছিলেন না।
:- কবে আর। ওনার স্মরণসভায়। যেবার আমার স্ত্রী মৃণালিনী চলে গেল, সেবছরই তো নরেনবাবুও…। কী লোক। যেমন সাহস, তেমন অপূর্ব চিন্তাধারা, আর তেমনি বক্তৃতা দেবার ক্ষমতা। আমার বাবাও তো ওঁকে খুব ভালবাসতেন। নরেনবাবু তো খুব খেতে পারত। বাবা ওকে সামনে বসিয়ে খাওয়াতেন। আর ওঁর কথা শুনতেন। বলতেন ছেলেটির কথায় যেন জাদু আছে। তোমরা তো ওনার কথা বা বক্তৃতা শোনোনি, তাই না?
:- মাত্র? ও বাবা। তুমি তো তার মানে আমার ছোট ছেলে শমীর চেয়েও ছোট।
নজরুল আবারও সলজ্জ হাসলেন।
:- শমীও খুব প্রতিভাবান ছিল জানো তো। আমাকে সবাই বলত ও নাকি আমার কার্বন কপি। তা সেও তো চলে গেল। মাত্র এগারো বছর বয়স ছিল।
:- কলেরা। মুঙ্গের গেছিল। বন্ধুর বাড়ি। সেখানেই। নজরুল চুপ করে রইলেন।
:- যেদিন শমী চলে গেল… রবীন্দ্রনাথ বলে চললেন। রাতের বেলা দেখি সারা পৃথিবী যেন চাঁদের আলোয় ধুয়ে যাচ্ছে। দেখলাম প্রকৃতি যেমনিভাবে চলে ঠিক তেমনভাবেই চলছে। কোথাও কোনো ব্যতিক্রম নেই। আমার এই শোকের দিনে যেন কারোর কিছু আসে যায় না। একটা ভারি অদ্ভুত অনুভুতি হল, জানলে!
নজরুল বড় বড় চোখ মেলে রবীন্দ্রনাথের দিকে চাইলেন।
:- মনে হল, ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টিকর্তার এটাই ইচ্ছা। মৃত্যু আসবেই, হয়ত অকালেই আসবে। শোকতাপ থাকবে। যেমন আনন্দও আছে। কিন্তু কাজ থামালে চলবে না। আমাদের আরব্ধ কাজ আমাদের করে যেতেই হবে। আর এইটেই হল মহাবিশ্বের পরম সত্য।
★★(কথোপকথন কাল্পনিক। কিন্তু ঘটনা সবই সত্য।
তথ্যসূত্র :
কাজী নজরুল - মুজফফর আহমেদ।
কবি ও সন্ন্যাসী - অমিতাভ চৌধুরী।
রবিজীবনী - প্রশান্তকুমার পাল)★★