মোঃ মুজাহিদুল ইসলামঃ
শিশুটির বয়স মাত্র ৫৭ দিন। মা লিমা টুকটাক কাজকর্ম করে সংসার চালান। স্বামী রঃ এক্সিডেন্টে ৫ বছর আগ থেকে পঙ্গু হয়ে ঘরে অবস্থান করছেন। স্বামী পয়পোলাপানের সংসার চালাতে গিয়ে দোকান বাকি, নগদ ঋণ মিলিয়ে ৩০ হাজার টাকার ঋণের তলে পড়ে যান লিমা। পোয়াতি হওয়ায় কাজকর্মেও যেতে পারছিলেননা লিমা বেশ কদিন ধরে। এ অবস্হায় ঋণে জর্জরিত লিমাকে পাওনাদাররা বার বার তাগাদা দিতে থাকে পাওনা টাকা পরিশোধে। এমনি এক সময় লিমার কোল জুড়ে আসে ফুটফুটে এক ছেলে সন্তান। মা খুব আদর করে আগের সন্তানের সাথে মিল রেখে নাম রাখেন হোসেন। মা লিমার এভাবে চলে যায় দেড় মাসের উপরে। ঋণের পাওনাদারদের তাগাদা আরো বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে মা লিমা সিদ্ধান্ত নেন সন্তান বিক্রি করে মানুষের পাওনা ঋণ পরিশোধ করার। খোঁজ দেয়া হয় কেউ সন্তান কিনে নিবে কিনা? ৫৭ দিনের মাথায় পেয়েও যান সন্তান কেনার এক নিঃসন্তান কাস্টমার দম্পতি। কাশেম-স্বর্ণা দম্পতি শিশু সন্তান বিক্রির খোঁজ পেয়ে ঢাকা জেলার দোহার থানার লারিসা গ্রাম থেকে ছুটে আসেন টঙ্গী পূর্ব আরিচপুরের আইনউদ্দিনের বাড়িতে হোসেনের ভাই হাসানকে কিনতে। গত সোমবার ৩০ হাজার টাকার বিনিময়ে হাসানকে কিনে নিয়ে যান কাশেম-স্বর্ণা দম্পতি। ৫৭ দিন বয়সের হোসেনকে বিক্রি করে মানুষের ঋণ পরিশোধ করে লিমা যখন বাসায় ফিরে আসেন তখন বাসাটায় যেন লিমা অনেক শূন্যতা অনুভব করতে থাকেন। একদিন যায়, দুদিন যায়, মা লিমাকে সন্তানের শূন্যতায় পাগল করে তোলে। নির্ঘুম রাত কাটতে থাকে লিমা। ৪৮ ঘন্টার মধ্যে সন্তানের জন্য পাগলের মতে হয়ে যায় লিমা। শিশু বিক্রির দুদিন না পেরোতেই সন্তানের জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠেন মা লিমা। কলিজাটা ছিড়ে যাচ্ছিল মা লিমার। না খেয়ে কাটে ৩ দিন। গলা দিয়ে দানাপানি যাচ্ছিল না দুধের শিশুকে কাছে না পেয়ে। বুকের দুধ সন্তানকে খাওয়াতে না পেরে অস্হির হয়ে পড়েন লিমা। ছটফট করতে থাকেন। প্রতিবেশীরা সান্তনা দিয়েও থামাতে পারছিলনা মা লিমাকে। একপর্যায়ে শিশু হোসেনকে কাছে পাওয়ার জন্য গগনবিদারী চিৎকার করতে থাকেন লিমা। এলাকার শত মানুষ জড়ো হয় লিমার এমন অবস্থা দেখে। মানুষজন খবর দেন পুলিশের 999 নাম্বারে। ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন টঙ্গী থানা পুলিশের এসআই ইয়াসির আরাফাত। এসে শুনেন ঘটনার মর্মস্পর্শী কাহিনি। খবর পান টঙ্গী পূর্ব থানার ওসি আশরাফুল ইসলাম। ছুটে যান ঘটনাস্থলে। গিয়ে দেখেন সন্তান হারা মা অঝোর ধারায় কান্না করছেন। সন্তানের জন্য দিক বি দিক ছুটাছুটি করছেন পাগলের মতো। ওসি আশরাফুল ইসলাম, সন্তান হোসেনকে ফিরে পেতে খোঁজ নেন ৩০ হাজার টাকায় সন্তান কিনে নেয়া নিঃসন্তান দম্পতি কাশেম-স্বর্ণার বাড়িতে। তাঁদেরকে পেয়েও যান ওসি। ওসি, মা লিমার পুরো ঘটনাটি জানান নিঃসন্তান দম্পতিকে। তাঁরা রাজি হন ৫৭ দিনের হোসেনকে ফেরত দিয়ে দিতে। টঙ্গী পূর্ব থানার ওসি আশরাফুল ইসলাম নিজ থেকে ৩০ হাজার টাকা পরিশোধ করে হোসেন নামের শিশুটিকে মা লিমার কোলে তুলে দিতেই সে কি যে আনন্দ, তা বলে বোঝানোর মত নয়, বললেন ওসি আশরাফুল ইসলাম। এমন খবর একান থেকে ওকান হতে না হতে পৌঁছে যায় টঙ্গীর হক গ্রুপ কোম্পানিতে। হক গ্রুপ মানবসম্পদ বিভাগের কর্মকর্তা হযরত আলী ঈশান টঙ্গী পূর্ব থানার ওসির কাছে মর্মস্পর্শী ঘটনাটি জানার পর শিশুটির বাবা মাসুমকে হক বিস্কুট কারখানায় চাকরির সুযোগ করে দেন। বৃহস্পতিবার বিকালে টঙ্গী পূর্ব থানা প্রাঙ্গনে এ ব্যাপারে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন গাজীপুর মহানগর পুলিশের উপপুলিশ কমিশনার মাহবুবউজ্জামান। টঙ্গী পূর্ব থানার ওসি আশরাফুল ইসলামের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ৩০ হাজার টাকার বিনিময়ে বিক্রি করা এক মায়ের সন্তানকে মায়ের কাছে ফিরিয়ে দিয়ে আজ আমার মনে হচ্ছে, সৃষ্টিকর্তা আমাকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ একটি কাজ করিয়েছেন।
ঋণ শোধে নিজ সন্তান বিক্রির পর সন্তানকে নিজের কোলে ফিরিয়ে দিয়ে পাগলিনী মায়ের বুক ফাটা কান্নার আর্তনাদকে যারা থামিয়ে দিয়েছেন আল্লাহ যেন তাঁদের কলিজা ঠান্ডা করে দেন। পৃথিবীর সব সন্তানদের হয়ে এই মা আবারও জানান দিলেন, সব সন্তানের মায়েরা এমনেরই হয়!