নিশুতি রাত। ঘড়ির কাঁটা দুটোর ঘরে। পেশাগত কাজ শেষে নিজেই ড্রাইভিং করে বাসায় ফিরছি।

নিশুতি রাত। ঘড়ির কাঁটা দুটোর ঘরে। পেশাগত কাজ শেষে নিজেই ড্রাইভিং করে বাসায় ফিরছি।

সত্যের খোঁজে আমরা

লোকাল লেনে গাড়ির তেমন আনাগোনা নেই। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর সাইনবোর্ড থেকে আসা নিয়ণ আলোয় কোথাও কোথাও অন্ধকার পালাচ্ছে।
পথে বিক্ষিপ্ত কিছু নেড়ি সারমেয়দের শোরগোল। কোনটি তার স্বরে ডাকছে। নির্জন আলো আঁধারি পরিবেশ। এর মধ্যেই অন্ধকারে খানা খন্দক মাড়িয়ে এগিয়ে চলছে আমার গাড়ি।

হটাৎ সামনে চোখ পড়লো পুলিশের একটা জীর্ণশীর্ণ গাড়ির দিকে। আচ্ছা! এসব গাড়ির আয়ু কি ফুরোয় না? এমন ভাবনা থেকে আমি ব্রেকে পা রাখলাম।

নেমে কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে সালাম বিনিময় করেই জানা গেলো, টহল দলটি সাভার মডেল থানার ৯৯৯ টিম। রাত্রিকালীন টহল সেইসঙ্গে জাতীয় জরুরি সেবার দায়িত্ব।

কনস্টেবল ভাইদের সাথে ক্রমেই জমে উঠলা আলাপ। দোকানপাট গুলো ঘুমিয়ে। রাস্তার পাশে পাততাড়ি গোটানোর প্রস্তুতিতে ডিমের ফেরিওয়ালারা।

এই ফাঁকে গরম সিদ্ধ ডিম অর্ডার করলাম। হালি আশি টাকা। বাজারে ডিমের দামের যে আঁচ, সে তুলনায় সেদ্ধ ডিম পিস প্রতি ২০ টাকা মানানসই।

এই টহল টিমের ডিউটি টাইম রাত আটটা থেকে পরদিন ভোর আটটা পর্যন্ত। টানা ১২ ঘন্টা। অবশ্য এটা আমার আগেই জানা।

নিজের মনেই প্রশ্ন, আচ্ছা এই যে আমরা এত মানবাধিকারের বুলি আওড়াই। ভিনদেশীরা আমাদের দেশে এসে মানবাধিকার কতশত সবক দেন। কিন্তু পুলিশের এই সদস্যরা যে একটানা ১২ ঘন্টা ডিউটি করছে। পরদিন কারো ট্রেনিং কিংবা সাক্ষী থাকলে ভোর কিংবা সকালেই আবার সেখানে ছুটে যাচ্ছে। জরুরী পরিস্থিতি কিংবা বিরোধী দলের আন্দোলন সংগ্রাম হলে তো কথাই নেই। স্বাভাবিক ছুটিছাটাও বন্ধ। বছরের পর বছর ধরে পুলিশ ভাইয়েরা কিন্তু এভাবেই ডিউটি করে আসছে। ভেতর থেকে এই মানুষদের জন্য বেশ মায়া হল।

পরিচয়ে জানা গেলো,এই টহল দলের টিম লিডার উপ-পরিদর্শক রাজু সরকার। সাধারণ মানুষদের সাথে কতিপয় পুলিশ সদস্যদের কিছু অপকর্মের ফিরিস্তি নিয়ে দিনের অভিজ্ঞতা বিনিময় করতেই অনেকটা বুক চিতিয়ে এসআই রাজু বললেন, ভাই পুলিশে চাকরি করি, কিন্তু সকাল বেলা একটা প্রতিজ্ঞা করে বাসা থেকে বের হই। যাতে হারামের পয়সা পেটে না যায়। যে বেতন পাই, আলহামদুলিল্লাহ।

প্রয়োজনে কম খাই, সাধারণভাবে চলি। কিন্তু ব্যক্তি জীবনে আমি অনেক সুখী। ডিউটিতে যাবার আগে স্ত্রী যখন পাশে এসে পরম মমতায় বিদায় জানায় তখন অন্যরকম একটা পার্থিব আনন্দ আরো মানসিক শক্তি যোগায়।

নাছোড়বান্দা তিনি। আমাকে নয়,বিলটা তিনিই দেবেন। এ নিয়ে চললো আমাদের মধ্যে কিছুটা প্রতিযোগিতা।

সবিনয়ে বললাম, ভাই গোটা এলাকা যখন ঘুমোচ্ছে তখন আপনারা খুটখুটে অন্ধকারের মধ্যে জেগে ডিউটি করছেন। আপনাদের আমিই আমন্ত্রণ জানিয়েছি। আপনারাই পুলিশের আস্থার স্থপতি।

আপনাদের মতো মানুষদের প্রতি শ্রদ্ধা আর ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে আজ না হয় আমিই সামান্য এই বিলটা দিই।

শেষমেষ তাই হল। কৃতজ্ঞতা ও ভালোবাসা নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও কাজ করে যাওয়া পুলিশের নিবেদিত প্রাণ সৎ কর্মীদের। আর যারা অসৎ। সবিনয়ে তাদের বলছি, ভাইরে টাকা দিয়ে সুখ শান্তি কেনা যায় না। গ্লানি আর লজ্জায় নিজের কাছেই ছোট হতে হতে নিঃশেষে বিলীন হয়ে যায় মেরুদন্ড। আর সেটা না থাকলে বেঁচে থাকার অর্থ বৃথা……

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *