সত্যের খোঁজে আমরা
পর্যায়ের সাংবাদিকেরা৷ হামলা নির্যাতনের সঙ্গে বড় চাপ ‘সাজানো মামলা’৷
বাগে আনতে না পারলে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সংবাদ সংশ্লিষ্ট নয় এমন নানা অপরাধমূলক মামলাও দেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে৷ এমনকি সন্ত্রাসী তৎপরতা, নাশকতা ও বিস্ফোরক আইনের মামলাও দেয়া হচ্ছে, করা হচ্ছে গ্রেপ্তার৷ সেই সঙ্গে জিডিটাল আইনের খড়গ তো আছেই৷ এসব নিয়ে সাংবাদিকেরাও তেমন প্রতিবাদ করছেন না৷ ভুক্তভোগী সাংবাদিকেরা বলছেন, কৌশল হিসেবেই তাদেরকে নানা ভাগে বিভক্ত করে দেয়া হচ্ছে, যাতে গ্রেপ্তার বা নির্যাতনের শিকার হলে প্রতিবাদ না হয়৷ আবার কেউ প্রতিবাদ করলে তাদের হুমকি দেয়া হয়৷ যার সবশেষ উদাহরণ সাতক্ষীরার সাংবাদিক রঘুনাথ খাঁ৷
সাতক্ষীরা সদর থেকে পুলিশ তাকে আটক করে বলে জানা যায়৷ এই তথ্য সাত ঘণ্টা গোপন রাখা হয়৷ এরপর সন্ধ্যায় সদর থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে আরেকটি উপজেলা দেবহাটা থানায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়৷ সেই থানায় তার বিরুদ্ধে নাশকতা ও চাঁদাবাজির মামলা দেয় পুলিশ৷ আটকের পর তাকে ইলেকট্রিক শক দিয়ে নির্যাতন করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে তার পরিবার৷ পাঁচ দিন কারাগারে থাকার পর রোববার তিনি জামিনে মুক্তি পেয়েছেন৷
আটকের পর জেলার সাংবাদিকেরা কোনো প্রতিবাদ করেননি৷ এমনকি এক পক্ষ এসপির কাছে গিয়ে উল্টো তাকে মিষ্টি খাইয়ে আসেন৷
একই ভাবে গত বছরের নভেম্বরে সংবাদ প্রকাশের কারণে রামগড়ের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) খন্দকার ইখতিয়ার উদ্দিন আরাফাতের রোষাণলে পড়েন স্থানীয় সাংবাদিক সাইফুল ইসলাম৷ তার বিরুদ্ধে জিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন ইউএনওর কার্যালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা জালাল আহমেদ৷ ‘ইউএনওর রোষাণলে পড়ে দুই দিনমজুর নিরাপত্তাহীন’, শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশ করেন তিনি৷ এর প্রেক্ষিতেই তার বিরুদ্ধে মামলা দেন ইউএনও৷
একই বছরের আগস্টে নেত্রকোনার কেন্দুয়ার ইউএনও মাহমুদা বেগম স্থানীয় এক সাংবাদিককে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে জড়িয়ে মামলার হুমকি দেন৷ দৈনিক সংবাদ ও দ্য ডেইলি স্টারের কেন্দুয়া প্রতিনিধি হমায়ুন কবির ভূমিহীনদের দেয়া প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘরে আগুন দেয়ার ঘটনার ভিডিও প্রকাশ করায় ইউএনও তার ওপর ক্ষুব্ধ হন বলে জানা যায়৷
২০১৯ সালে বরিশালের গৌরনদী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা গোলাম সারোয়ার স্থানীয় সাংবাদিক মোল্লা ফারুক হাসান ও রফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে ডিজিটাল আইনে মামলা করেন৷ ওসির বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসায় পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগ নিয়ে খবর প্রকাশ করায় ওই মামলা দেয় হয়৷
যা বলছেন ভুক্তভোগী সাংবাদিকেরা
কুড়িগ্রামে গ্রেপ্তার ও নির্যাতনের শিকার সাংবাদিক আরিফুল ইসলাম রিগ্যান বলেন, ‘‘এখন জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সাংবাদিকতা করা কঠিন হয়ে পড়ছে৷ কোনো প্রতিবেদন পুলিশ বা প্রশাসনের বিরুদ্ধে গেলেই হুমকি , নির্যাতন বা মামলার শিকার হতে হচ্ছে৷”
তিনি বলেন, ‘‘প্রেসক্লাব বা সাংবাদিক ইউনিয়নের নেতাদের বড় একটি অংশ এখন পুলিশ ও প্রশাসনের সুবিধাভোগী৷ ফলে তারা তো অনিয়ম, দুর্নীতির খবর প্রকাশ করেনই না, উপরন্তু কেউ ওই ধরনের খবর প্রকাশ করে হামলা মামলার শিকার হলে তারা প্রতিবাদও করেন না৷ কেউ প্রতিবাদ করলে তাকেও একই পরিণতির শিকার হতে হয়৷ যার বড় প্রমাণ আমি নিজে৷’’
খুলনার আরেকজন নির্যাতিত সাংবাদিক রকিবউদ্দির পান্নু বলেন, ‘‘স্থানীয় পর্যায়ে সাংবাদিকতা অনেক ঝুঁকিপুর্ণ হয়ে উঠছে৷ কারণ পুলিশ প্রশাসন চায় না তাদের অনিয়ম, দুর্নীতি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ হোক৷ প্রকাশের আগেই তারা নানাভাবে চাপ সৃষ্টি করে৷ আর প্রকাশ হলে মামলায় জড়িয়ে দেয়৷ সেই মামলা প্রকাশিত খবর নিয়ে নয়, মামলা করা হয় চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধে৷ তাদের লোকেরাই সাজানো মামলা করে৷ জিজিটাল নিরাপত্তা আইন তো আছেই৷”
তিনিও মনে করেন, এইসব মামলা বা হয়রানির তেমন প্রতিবাদ না হওয়ার কারণ স্থানীয় প্রেসক্লাব ও সাংবাদিক ইউনিয়নে নানা ধরনের বিভক্তি৷ ‘‘অপসাংবাদিকতাও এখন বেশ বেড়েছে,” বলেন পান্নু৷
পুলিশ প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতারা এগিয়ে
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র(আসক) তাদের প্রতিবেদনে বলেছে গত বছর (২০২২) সারদেশে ২২৬টি সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে৷ এর ৯০ ভাগেরও বেশি ঢাকার বাইরে জেলা ও উপজেলায়৷ আর এই নির্যাতন ও হুমকির ঘটনা বেশি ঘটিয়েছে পুলিশ, প্রশাসন ও রাজনৈতিক ব্যক্তিরা৷ আর সরাসরি খবর প্রকাশের কারণে ওই খবরের ঘটনায় মামলা হয়েছে ৪১টি৷
আর্টিক্যাল ১৯-এর হিসেবে ওই সময় ৬১ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছে৷ ছয়জন সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে৷ এইসব মামলায়ও পুলিশ প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতারা এগিয়ে৷
বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি মো. ওমর ফারুক বলেন, ‘‘স্থানীয় পর্যায়ে পুলিশ ও প্রশাসন এখন সাংবাদিকদের চাপে রাখতে চায়৷ তাই তারা সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের মামলা করছে৷ যারা স্বাধীনভবে সত্য ঘটনা প্রকাশ করতে চায় এর মাধ্যমে তারা অন্য সাংবাদিকদের মেসেজ দিচ্ছে৷ একটা ভয়ের পরিবেশ তৈরি করছে৷ এটা স্বাধীন সাংবাদিকতার পথে অন্তরায়৷”
তিনি জানান, ‘‘আমি শুনেছি স্থানীয় পর্যায়ে এইসব ঘটনায় সাংবাদিকেরা অনেক সময় প্রতিবাদও করেন না৷ এটা ভয়াবহ৷ এটা চলতে থাকলে নির্যাতন, মামলা, হুমকি আরো বেড়ে যাবে৷”
তার মতে, ‘‘সাংবাদিকতা এখন নানা কারণে তার আদর্শের জায়গা থেকে বিচ্যুত হচ্ছে৷ কোনো কোনো সাংবাদিক পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে নানা অনৈতিক সুবিধা নিচ্ছেন৷ তারা সাংবাদিকতার পরিবেশ নষ্ট করছেন৷ আবার সাংবাদিকদের মালিক পক্ষ বিজ্ঞাপনের জন্য কাজ করাচ্ছে৷ স্থানীয় পর্যায়ে পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গে সুসম্পর্ক না থাকলে তো বিজ্ঞাপন দেয় না৷ সব মিলিয়ে একটা জটিল পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে৷’