………………………………………………………………………………………
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে দণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করায় ক্ষমতাসীন দলের ভাতৃপ্রতিম সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের অর্ধশতাধিক নেতাকর্মীকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
বহিষ্কৃতরা দেশের বিভিন্ন জেলায় ছাত্রলীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা।
এদিকে সাঈদীকে চিকিৎসা দেওয়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসক এস এস মোস্তফা জামানকে হত্যার হুমকি দেওয়া ছাত্র শিবিরের কর্মী তাফসিরুল ইসলামকে বৃহস্পতিবার ঝিনাইদহ থেকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব।
এ ছাড়া সাঈদীর মৃত্যুর সঙ্গে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টকে মিলিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বঙ্গবন্ধু হত্যার পক্ষে পোস্ট দেওয়ায় বৃহস্পতিবার চাঁপাইনবাবগঞ্জে আরেক শিবির নেতাকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
তার আগে নওগাঁয় আওয়ামী লীগের শোক সভায় সাঈদীর জন্য দোয়া চাওয়ার পর বুধবার গ্রেপ্তার হয়েছেন স্থানীয় মসজিদের এক ইমাম।
ছাত্রলীগের একাধিক নেতা বলছেন, ছাত্রলীগের আদর্শের সঙ্গে স্বাধীনতাবিরোধী সাঈদীর প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ সাংঘর্ষিক এবং অগ্রহণযোগ্য। বহিষ্কৃত ওই নেতাদের দলে অনুপ্রবেশকারী বলে আখ্যায়িত করছেন তাঁরা।
তাঁদের মতে, সাঈদীর মৃত্যুর মাধ্যমে “অনেকের চেহারা উন্মোচিত হয়েছে।”
গত ১৪ আগস্ট রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যাওয়ার পর সাঈদীকে বিশ্ববরেণ্য ইসলামী বক্তা, কোরানের পাখিসহ বিভিন্ন উপাধিতে আখ্যা দিয়ে তাঁর মৃত্যুর জন্য শোক প্রকাশ করে জামায়াতসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। যদিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সাঈদীকে নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় ওঠে। ফেসবুকে অনেকে ঘোষণা নিয়ে সাঈদীর পক্ষে মন্তব্যকারীদের ব্লক করেন। গত পাঁচ দিন ধরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বিশেষ করে ফেসবুক সরগরম রয়েছে সাঈদীর পক্ষে-বিপক্ষের নানা মন্তব্যে।
জামায়াত এবং পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়, সাঈদীকে বিনা চিকিৎসায় হত্যা করেছে ক্ষমতাসীন দল। তবে এই অভিযোগ অস্বীকার করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বুধবার জানায়, তাঁর সঠিক চিকিৎসা করা হয়েছে।
ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কার অন্তত ৫৪ জন
সাঈদীর প্রশংসা করে তাঁর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করায় মোট ৫৪ জনকে বহিষ্কার করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার নরসিংদীর সাত ছাত্রলীগ নেতাকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে বলে জেলা ছাত্রলীগের এক বিবৃতিতে জানানো হয়।
একইভাবে বুধবার ও বৃহস্পতিবার দু’দিনে চট্টগ্রামে মোট নয় ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
বুধবার জামালপুরে ১৭ ছাত্রলীগ নেতাকে সংগঠন থেকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে এবং সাঈদীর মৃত্যুতে ফেসবুকে শোক প্রকাশ করায় তাঁদের কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়া গত দুই দিনে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ১৭ জন, সাতক্ষীরায় তিন জন, ঠাকুরগাঁয়ে একজনকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে বলে ছাত্রলীগের পৃথক বিবৃতিতে জানানো হয়।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শাজাহান খান বেনারকে বলেন, “এটা সত্যিই দুঃখজনক যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদানকারী ছাত্রলীগের নেতারা স্বাধীনতাবিরোধী, রাজাকার ও যুদ্ধাপরাধী সাঈদীর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছে।”
তিনি বলেন, “এর কারণ হলো, এসব নেতা-নেত্রীরা ছাত্রলীগের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর। এরা এসেছে ক্ষমতাসীন দলের নাম ব্যবহার করে সুবিধা নিতে।”
শাজাহান খান বলেন, “এরা বঙ্গবন্ধু অথবা ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগের আদর্শ; কোনো কিছু সম্পর্কেই জানে না। আবার আমাদের কিছু নেতা-নেত্রী এদের দলে নিয়েছে।”
তিনি বলেন, “তবে হ্যাঁ, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সাঈদীর মৃত্যুর মাধ্যমে আমরা অনেকেই চিনতে পারলাম যা ভবিষ্যতে দল গোছানোর কাজে সাহায্য করবে।”
নওগাঁয় বিব্রতকর ঘটনা
ক্ষমতাসীন দলের জন্য বিব্রতকর ঘটনা ঘটেছে নওগাঁ জেলা আওয়ামী লীগ আয়োজিত ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসের অনুষ্ঠানে।
নওগাঁ সদর আসনের সংসদ সদস্যের উপস্থিতিতে ইমাম মোয়াজ্জেম হোসেন বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের জন্য দোয়া করার পর দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীর জন্য দোয়া চাইতে শুরু করেন।
সঙ্গে সঙ্গে দলীয় নেতা-কর্মীরা প্রতিবাদ করতে থাকলেও সাঈদীর জন্য দোয়া চাইতে থাকেন মোয়াজ্জেম হোসেন।
পরদিন বুধবার পুলিশ তাঁকে এবং স্থানীয় আরেক ব্যবসায়ীকে নাশকতার আরেকটি মামলায় আটক করে। আদালতে সোপর্দ করা হলে তাঁদের জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠায় আদালত।
কোন অভিযোগে তাঁদের আটক করা হলো এমন প্রশ্নের জবাবে নওগাঁ সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মু. ফয়সাল বিন আহসান বেনারকে বলেন, “ওই ইমাম ও তাঁর সঙ্গে যাঁকে আটক করা হয়েছে, সেই ব্যবসায়ী দেলাওয়ার হোসেন পূর্বের একটি নাশকতা মামলার আসামি। তাঁদের বিরুদ্ধে তদন্তে অভিযোগ পাওয়া গেছে। সেই মামলায় তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে।”
চাঁপাইনবাবগঞ্জে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা
জেলার পুলিশ সুপার ছাইদুল হাসান বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, “জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবিরের কর্মী মাসুদ রানা সাঈদীর গায়েবানা জানাজা করতে না দেওয়ায় সরকারের সমালোচনা করে এবং ১৫ আগস্টের ঘটনাকে সমর্থন করে পোস্ট দেন।”
তিনি জানান, মাসুদ রানা জেলার ভোলাহাট উপজেলার বাসিন্দা।
ভোলাহাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. সেলিম রেজা বেনারকে বলেন, “মাসুদ রানাকে আটকে আদালতে সোপর্দ করা হয়েছে। তাঁর পোস্টে যাঁরা লাইক দিয়েছেন তাদের পাঁচ জনকে আসামি করা হয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, “তাঁর বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২১, ২৫ ও ২৯ ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে। অর্থাৎ তিনি এই পোস্টের মাধ্যমে রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করেছেন এবং জনমনে ভীতির সঞ্চার করেছেন।”
জামায়াতের প্রতিবাদ
সদ্য প্রয়াত সাঈদীর ছেলেসহ দলের কয়েক হাজার নেতা-কর্মীকে আসামি করে মামলা ও গ্রেপ্তারের প্রতিবাদ জানিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। ‘শোকের’ মধ্যে সরকারের এই কর্মকাণ্ডকে ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ বলে মন্তব্য করে দলটি বলেছে, বর্তমান সরকারের মতো এত জুলুম-নির্যাতন অতীতে এ দেশের মানুষ কখনো প্রত্যক্ষ করেনি।
বৃহস্পতিবার রাতে এক বিবৃতিতে জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল এ টি এম মা’ছুম এ কথা বলেন।
বিবৃতিতে বলা হয়, ইতিমধ্যে বগুড়ার ধুনট থেকে জামায়াতের ২ জন নেতাসহ ২২ জন, পাবনার ঈশ্বরদী, সাঁথিয়াসহ বিভিন্ন উপজেলা থেকে ৩৩ জনসহ সারা দেশে জামায়াত ও ছাত্রশিবিরের ২ শতাধিক নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।