স্মৃতিকথা ২: পোড়া চোখে যা দেখিলাম অন্তত আমার স্মৃতিতে তো শহরটা ওরকমই। বয়স

স্মৃতিকথা ২: পোড়া চোখে যা দেখিলাম অন্তত আমার স্মৃতিতে তো শহরটা ওরকমই। বয়স

তখন কত হবে? এই দুই কি তিন, বড়জোর চার! তারপর তো ঢাকাতেই চলে এলাম। অবাক হয়ে যাই এই ভেবে যে, আমার ওখানকার কিছু কথা এখনো কি করে মনে আছে। আসলেই কি মনে আছে? নাকি এসবই আসলে আব্বা-আম্মার কাছে থেকে অনেকবার শোনা গল্প? কে জানে…।

মনে পড়ে, একটা টিনের চালের বাসা, পেছনে একটা ছোট্ট খালি জায়গা, পাশে রান্না ঘর। তাতে আম্মা রান্না করছেন। মাছ ভাজার ছ্যাঁত ছ্যাঁত শব্দ হচ্ছে। ঘরের ভেতর একটা মিটশেপ, একটা চৌকি, একটা টেবিল, একটা আলনা। আর ছিল একটা থ্রি-ব্যান্ড রেডিও। এই ছিল আমাদের সম্বল। বেশ খানিকটা দূরে একটা উঁচু রাস্তা। রাস্তার ওপরটা দেখা যায় না, শুধু তার ঢালু পাড় দেখা যায়। আর মাঝে বালির সমুদ্র। আমি জানি না সত্যিই কি তখন অত বালি থাকত কি না? আমি পরে আম্মাকে জিজ্ঞেস করেছি, ‘আচ্ছা আম্মা, ঈশ্বরগঞ্জ কি বালিতে ভর্তি কোনো শহর ছিল?’

– হুম, আম্মার ছোট্ট উত্তর।

আরও মনে আছে, আমাদের সেই বাসার পাশেই ছিল একটা চারদিক খোলা ঘর। কেন জানি না ওখানে এসে জড়ো হতো রাজ্যের ভিক্ষুক। সকালে ঘুম ভেঙে যেত তাদের তারস্বরে চিৎকারে। অনেক পরেও এমন করে ঘুম ভেঙে যেত আমার। আর তা হলো, ঢাকার অসংখ্য কাকের চিৎকারে। এখন অবশ্য এমনিতেই, কোনো কারণ ছাড়াই মাঝ রাতে ঘুম ভেঙে যায় আমার। কোনো ভিক্ষুক কিংবা কাকের চিৎকারের দরকার হয় না।

আম্মার অনেক শখ ছিল সিনেমা হলে গিয়ে চলচ্চিত্র (তখন তাঁরা বলতেন বাংলা বই) দেখার। সাথে আমাদেরও নিয়ে যেতেন। মনে আছে তেমনই একটি চলচ্চিত্রের একটা গান, ‘কচি ডাবের পানি’! গানের শুধু এই কথা ক’টি আর গানের দৃশ্যে কেউ একজন হেলে দুলে নাচছে মনে আছে। ব্যস, ওটুকুই, আর কিছু মনে নেই। এমন কোনো গান সত্যিই আছে কিনা, যাচাই করিনি। তখন তো আর ইউটিউব ছিল না। কিন্তু সম্প্রতি পরখ করতে গিয়ে ঠিকই পেয়ে গেলাম। ‘কচি ডাবের পানি, দু’আনা দিয়ে খেয়ে নাও’ গানের সাথে নাচছেন ববিতা। সাথে সাইফুদ্দিন সাহেব। কী আশ্চর্য!

অনেক পরে, এই তো কিছুদিন আগে, হঠাৎ নেত্রকোণার আশপাশে কোনো একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে যাচ্ছি। জানলাম, সে রাস্তায় ঝামেলা। কাজ চলছে, কিংবা গাছ ভেঙে পড়ে আছে। তাই ঘুর পথে গাড়ি চলল। আমাদের গাড়ি একটি জায়গায় কিছু সময়ের জন্য থামল। বিশ্রাম ও চা-পানের জন্য। আব্বা বললেন, এই সেই ঈশ্বরগঞ্জ শহর আমার প্রথম কর্মস্থল। আমি চমকে উঠলাম। মাথা ঘুরিয়ে চারপাশটা দেখার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কিছুই মেলাতে পারলাম না। চারদিকে মানুষ গিজগিজ করছে। দোকানপাট, চিৎকার চেঁচামেচি। কোনো খোলা জায়গা চোখে পড়ল না। স্মৃতির বালির শহরটি আমার কোথায় কোন চোরাবালিতে হারিয়ে গেল!

মনে আছে, একবার সদ্য মাঞ্জা দেওয়া সুতোয় আমার হাত কেটে যায়। ঘুড্ডির উপর আমার হাতের রক্ত কয়েক ফোঁটা। আবার সেই রক্ত শুকিয়ে গেলে ঘুড়িটি আকাশে ওড়ালাম। মনে মনে চাইলাম যেন কাটাকাটি খেলায় আমার ঘুড্ডিটা ভোকাট্টা হয়ে যায়। আর পরে যে-ই সেটি পাবে, তাতে থাকবে আমার রক্তের চিহ্ন। যেন রক্ত দিয়ে লেখা একটা কাল্পনিক চিঠি, আকাশের ঠিকানায়। কী ছেলেমানুষি খেয়াল! আমি তো আসলেই তখন ছেলেমানুষ ছিলাম। কিন্তু আমার সে চাওয়াটা পূরণ হয়নি। আমাদের বাসার পাশেই ছিল জিল্লুর ভাই। প্রতিদিন ছাদে উঠে সেও ওড়াত ঘুড্ডি, এবং আমার কাছে তাকে লাগত গল্পের নায়কের মতো। সে ছিল কিছুটা আমার অভিভাবকের মতো। কোনো ঘুড্ডি যদি একটুও চেষ্টা করেছে কাছে আসতে, অমনি জিল্লুর ভাইয়ের ঘুড্ডি কোত্থেকে দুর্ধর্ষ গতিতে এসে প্রতিপক্ষের ওপর গোত্তা দিয়ে পড়ত। আর জোরে হাঁক দিয়ে আমাকে বলত, ‘তোর ঘুড্ডি বোটে (গুটিয়ে) ফেল পাভেল। আমি এই শালাকে দেখছি।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *