গাউসুল আ’যম
ইসলাম ও মুসলমানদের ইতিহাসে হযরত বড়পীর গাউসুল আ’যম মুহিউদ্দীন শায়খ আবদুল ক্বাদির জীলানী রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর শুভ আবির্ভাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও বরকতমন্ডিত। হিজরী পঞ্চম শতাব্দির শেষার্ধে একদিকে ইসলামের শত্রুদের নানাবিধ চক্রান্ত, অন্যদিকে বিভিন্ন ভ্রান্ত ও পথভ্রষ্ট জনগোষ্ঠী এবং উদাসীন শাসকবর্গের অস্বাভাবিক আদর্শচ্যুতির কারণে মুসলমানদের অবস্থা একেবারে শোচনীয় হয়ে পড়েছিলো।
সর্বোপরি যখন মুসলিম সমাজে দ্বীন-ইসলাম মৃতপ্রায় হয়ে পড়লে একজন অসাধারণ বেলায়তী শক্তি সম্পন্ন সংস্কারক ও পুনরুজ্জীবিতকারীর জন্য আর্তনাদ ধ্বনিত হচ্ছিলো, ঠিক তখনই শায়খ ‘মুহিউদ্দীন গাউসুল আ‘যম শাহানশাহে বাগদাদের শুভ জন্ম হয়েছিলো। তিনি তাঁর খোদাপ্রদত্ত ‘গাউসিয়াত-ই কুবরা’র অসাধারণ প্রজ্ঞা ও ক্ষমতাবলে দ্বীন-ইসলামকে সার্বিকভাবে পুনর্জীবিত করেন। তাঁর পবিত্র জন্ম, শিক্ষার্জন, রিয়াযত ও সংস্কার পদ্ধতি
ও এর সুদূরপ্রসারী সুফল ইত্যাদি -সবই কারামত বা অলৌকিকই ছিলো। তাঁর এ কারামতের সংখ্যাও অগণিত। বিশ্ব বরেণ্য অনেক বিজ্ঞ ইমাম ও ওলামা-ই কেরাম তাঁর কারামতগুলো অতি নির্ভরযোগ্য পন্থায় লিপিবদ্ধ করেছেন। যার ফলে হুযূর শাহানশাহে বাগদাদের কারামত ও গাউসিয়াতের বিষয়টি মানব সমাজের সর্বস্তরে সবিশেষ প্রসিদ্ধ। আমি এ নিবন্ধে হুযুর গাউসে পাকের সংক্ষিপ্ত জীবনী ও তার ওই অসংখ্য কারামতের কিছুটা উল্লেখ করে বরকত হাসিল করার প্রয়াস পেলাম।
জন্ম শরীফ
ওলীকুল শিরোমণি গাউসুল আ’যম শায়খ আবদুল ক্বাদির জীলানী কুদ্দিসা সিররুহ ৪৭০হি., ১ রমযানুল মুবারক জুমাবার সুবহে সাদিক্বের কিছু পূর্বে জন্ম গ্রহণ করেন। এটাই প্রসিদ্ধতম অভিমত। জন্মস্থান- অনারবীয় ভূখন্ড তাবারিস্তানের পাশে ‘গীল’ বা ‘গীলান’, আরবীতে ‘জীল’ বা ‘জীলান’।
আঠার বছর বয়সে তিনি বাগদাদে তাশরীফ নিয়ে যান। সেখানেই ৯০/৯১ বছর বয়সে তাঁর ওফাত হয় এবং সেখানেই তাঁর মাযার শরীফ অবস্থিত। [সূত্র- ‘আল বিদায়াহ্ ওয়ান নিহায়াহ্’ কৃত- ইমাম হাফেয ইবনে কাসীর দামেস্কী এবং নাফহাতুল উন্স’ কৃত- আল্লামা আব্দুর রহমান জামী]
অবশ্য, শায়খ আবুল ফাদ্বল সালিহ্ জীলী বলেছেন, হুযূর গাউসে পাকের জন্মসাল ৪৭১ হি.। তারিখ ও সময়ে উভয়ে একমত। এ মতভেদের কারণ হচ্ছে হযরত গাউসুল আ’যম রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুকে এ সম্পর্কে কেউ জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেছিলেন, “যে বছর আমি বাগদাদ এসেছি, তখন ছিলো ৪৮৮ হিজরী আর আমার বয়স ছিলো আঠার বছর।” হুযূর গাউসে পাকের এ উক্তি থেকে কেউ বুঝে নিয়েছেন যে, তখন তাঁর আঠার বছর পূর্ণ হয়েছে।
আর কেউ কেউ মনে করেছেন যে, তখন তিনি অষ্টাদশ বছরেই ছিলেন। এরপর কেউ কেউ ইমাম ইয়াফি’ঈর কথামত হযরত গাউসুল আ’যমের জন্মসাল ৪৭০ হিজরী লিখেছেন, আর কেউ কেউ শায়খ আবুল ফাদ্বলের কথামতো ৪৭১ হিজরী লিখেছেন। আবজাদের হিসাবানুযায়ী, আরবী (ইসক্ব) শব্দে তাঁর জন্মসাল প্রকাশ পায়, অর্থাৎ ৪৭০, অথবা (আশিক্ব) থেকে, অর্থাৎ ৪৭১ হিজরী।
উল্লেখ্য, এ পবিত্র জন্ম থেকেই তাঁর কারামত প্রকাশ পেতে থাকে। তিনি ১ রমযান জন্মগ্রহণ করতেই সেদিন থেকে রোযা পালন করেন। সারাদিন তিনি মায়ের দুধ পান করেন নি। এমনকি অন্যান্য মুসলমানকেও রোযা পালনের সুযোগ করে দেন। কারণ, পূর্ববর্তী দিন ছিলো ২৯ শা’বান। আকাশ ছিলো মেঘাচ্ছন্ন।
তাই আকাশে ওই দিন সন্ধ্যায় রমযানের চাঁদ দেখা যায়নি। তাই এ দিনটি কি ৩০ শা’বান, না ১লা রমযান এতে সন্দেহ ছিলো। উল্লেখ্য, তাঁর আম্মাজানের বর্ণনানুসারে, পুরো শৈশবে তিনি এভাবে রোযা পালন করেছেন। শত চেষ্টা করেও তাঁকে সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত দুধ পান করানো যেতো না। সুবহানাল্লাহ।
এটাতো হযরত গাউসূল আ’যমের জন্মকালের কারামত। মাতৃগর্ভে থাকাবস্থায় তাঁর কারামত আরো আশ্চর্যজনক। তা হচ্ছে- মাতৃগর্ভেই তিনি পবিত্র ক্বোরআনের আঠার পারা মুখস্থ করে ফেলেছিলেন। তাঁর আম্মাজান আঠার পারার হাফেযা ছিলেন। তিনি প্রতিদিন এ আঠারা পারা অবশ্যই তিলাওয়াত করতেন। তার নিকট শুনে মাতৃগর্ভে থাকাবস্থায় তিনি এ আঠার পারা মুখস্থ করে ফিলেছিলেন। তাঁর প্রমাণ পাওয়া যায় এভাবে যে, ইসলামী নিয়মানুসারে শৈশবে তাঁকে মক্তবে সর্বপ্রথম সবক দেওয়ার সময় ওস্তাদ মহোদয় বললেন, পড়ো ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’।
অমনি শিশু গাউসুল আ’যম জীলানী ‘বিসমিল্লাহ শরীফ’ পাঠ করার পর সূরা ফাতিহা পাঠ করে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি একটানা ১৮ পারা তিলাওয়াত শেষ করতে থাকলেন। আর সবাই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে শুনতে রইলেন। এটা কিভাবে সম্ভব হলো জানতে চাওয়া হলে এ মাদারজাত ওলী বলেছিলেন- মায়ের গর্ভে থাকাকালে মায়ের তিলাওয়াত শুনেই তিনি এ আঠার পারা মুখস্থ করে ফেলেছেন।
তাছাড়া, গর্ভে থাকাবস্থায় মায়ের আব্রূ রক্ষার ঘটনা (কারামত) ও সবিশেষ প্রসিদ্ধ। হযরত বড়পীর রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর বয়স যখন দশ বছর, তখন একদিন তিনি এক কথার জবাবে আপন আম্মাজানকে বললেন, “আপনার গর্ভে থাকাস্থায় আমিও আপনার উপকার করেছিলাম।” আম্মাজান অবাক হয়ে গেলেন আর বললেন,“তা কিভাবে?” তিনি বললেন, “একদিন আপনি ঘরে একা ছিলেন। তখন এক ভিক্ষুক এসে কিছু খাদ্য চেয়েছিলো। ঘরের বাইরে থেকে সে অসহনীয় ক্ষুধার কথা উল্লেখ করে বারংবার খাবার চাচ্ছিলো।
কিন্তু কোন সাড়া না পেয়ে এ বলে চলে যাবার মনস্থ করলো ‘হায়! আজ হয়তো ক্ষুধার জ্বালায় মরেই যাবো।” এটা শুনে, হে আম্মাজান, আপনার মনে দয়া ঢেউ খেললো। আপনি পর্দার আড়ালে নিম্নস্বরে ভিক্ষুকের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘তোমার জন্য বারান্দায় খাবার দিয়েছি। সেখানে গিয়ে খেয়ে নাও। পর্দার আড়ালে থেকে তিনি এ খাবার দিয়েছিলেন।
ভিক্ষুকও খাবারটুকু আহার করলো। কিন্তু এরপর তার মনে শয়তানী খেয়াল চেপে বসলো। সে কুপ্রবৃত্তির বশবর্তী হয়ে আন্দর মহলের দিকে পা বাড়াতে লাগলো। অমনি একটি গায়েবী বাঘ এসে উক্ত ভিক্ষুককে মেরে ফেলেছিলো। আর আল্লাহ্ তা’আলা আপনার আব্রæ রক্ষা করেছিলেন।
বলুন তো ওই বাঘ কে ছিলো? আম্মাজান বলেন; কিন্তু বাঘটির রহস্য কি ছিলো, তুমি বলো! তিনি বললেন, “আল্লাহ তা’আলার নির্দেশে ওইদিন আমার রূহ আপনার গর্ভ থেকে বের হয়ে বাঘের সূরত ধরে ওই শয়তান ভিক্ষুককে হত্যা করেছিলো। এটা শুনে ওই রত্মগর্ভা আম্মাজান আল্লাহর শোকরিয়া আদায় করলেন। [সূত্র- ‘মু’জিয়া-ই আম্বিয়া ও কারামতে আউলিয়া]
বাক্যকাল ও ছাত্র জীবন:
তিনি নিজেই বাল্যজীবনের বর্ণনা এভাবে দিয়েছেন- আমি আমার সমবয়সী ছেলেদের সাথে কখনো খেলাধূলার দিকে অগ্রসর হতে চাইতাম; কিন্তু আমি অদৃশ্য থেকে আওয়াজ শুনতাম “আবদুল ক্বাদির! খেলাধূলা থেকে বিরত থাকো।” আমি ভয় পেয়ে যেতাম আর দৌড়ে গিয়ে আমার মায়ের আঁচলের নীচে আশ্রয় নিতাম।
কখনো ঘুমানোর ইচ্ছা করলেও একই ধরনের আহবান শুনতাম, “তোমাকে এজন্য সৃষ্টি করা হয়নি, ওঠো!” বাল্যকালে আমি শিশুসূলভ আচরণে এক গাভীর লেজ ধরে টান দিতেই সেটা বললো, “আবদুল ক্বাদির, এতদুদ্দেশ্যে তুমি সৃষ্ট হওনি।” সাথে সাথে আমি সেটা ছেড়ে দিলাম এবং অজানা ভয় আমাকে পেয়ে বসলো।
হযরত বড়পীর গাউসুল আ’যমকে যখন মক্তবে পাঠানো হতো, তখন একদল ফিরিশ্তা তাকে মক্তবে পৌছিয়ে দিতেন। মক্তবে ছাত্রদের ভিড়ের কারণে বসার জায়গা থাকতো না। হঠাৎ সকলে গায়বী আওয়াজ শুনতে পেতো- تفسحوا لولى الله (তোমরা আল্লাহর ওলীর জন্য জায়গা করে দাও)!
উক্ত মক্তবের আরেক দিনের ঘটনা। এক দরবেশ মক্তবে আসলেন। হুযূর গাউসে পাক আগমন করলে এক গায়বী আওয়াজ শুনতে পেলেন, “তোমরা আল্লাহ্র ওলীর জন্য জায়গা করে দাও।”
তখন ওই দরবেশ ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন –
سيكون له شأن عظيم – يعظم فلا يمنع ويتمكن فلا يحجب – ويقرب فلايمسك –
অর্থাৎ: এ বালক অবিলম্বে অতিমাত্রায় উচ্চ মর্যাদার অধিকারী হবেন। তিনি বিনা বাধায় সম্মানিত হবেন। তিনি বিনা অন্তরালে মিলন লাভে সক্ষম হবেন। তিনি নৈকট্য লাভ করে ধন্য হবেন, তাঁকে রুখা যাবে না। হুযূর গাউসে পাক বলেছেন, দীর্ঘ চল্লিশ বছর পর আমি এ দরবেশের সাক্ষাৎ পেয়েছি। তখন বুঝতে পেরেছিলাম- তিনি অন্যতম আবদাল ছিলেন।
কৈশোর ও উচ্চশিক্ষার জন্য বাগগদাদ যাত্রা
বাল্যকালেই হযরত গাউসুল আ’যম রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর পিতা ইন্তিকাল করেন। তিনি ছেলের উচ্চ শিক্ষার জন্য ৪০টি দিনার তাঁর স্ত্রী অর্থাৎ হুযূর গাউসে পাকের আম্মাজানের নিকট রেখে যান। এ কারণে হুযূর শাহানশাহে বাগদাদকে পিতার সংসারের হালও ধরতে হলো। সুতরাং তিনি একদিন গাভী নিয়ে মাঠে যাচ্ছিলেন। গাভীটি পেছনের দিকে ফিরে মানুষের মতো বিশুদ্ধ আরবী ভাষায় বললো-
ياعبد القادر مالهذا خلقت الا بهذا امرت –
অর্থাৎ, এ কাজের জন্য না আপনাকে সৃষ্টি করা হয়েছে, না আপনাকে এ কাজ করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
গাভীর মুখে এ সতর্কবাণী শুনে তিনি বুঝতে পারলেন এক মহান কাজের জন্য তাঁকে সৃষ্টি করা হয়েছে। আর ওই মহান দায়িত্ব পালনের জন্য তাঁকে দ্বীনী উচ্চ শিক্ষা লাভ করতে হবে। সুতরাং তিনি উচ্চ শিক্ষার্জনের জন্য বাগদাদ চলে যেতে মনস্থ করলেন এবং আপন মায়ের নিকট অনুমতি প্রার্থনা করলেন।
বার্দ্ধক্যেও একমাত্র পার্থিব অবলম্বন আপন পুত্রকে অশ্রূসজল নয়নে বিদায় দিতে সম্মত হন তিনি। তখন বাগদাদ নগরী যেমন ব্যবসার প্রাণকেন্দ্র, তেমনি বিদ্যা শিক্ষা ও জ্ঞানচর্চারও কেন্দ্রস্থল ছিলো। সুতরাং হুযূর গাউসে পাক এক ব্যবসায়ী কাফেলার সাথে বাগদাদেও উদ্দেশে রওনা হন। তখন তাঁর বয়স আঠার বছর আর মায়ের বয়স আটাত্তর বছর।
দ্বীন ও মাযহাবের খাতিরে এ মহীয়সী, জ্ঞান ও গুণবতী মহিলা আপন সন্তানের পড়ার খরচ বাবদ স্বামীর প্রদত্ত ওই গচ্ছিত ৪০ টি দীনার সন্তানের জামার বগলের নীচে পকেট সেলাই করে ওই পকেটে দিয়ে বললেন- “তোমাকে আল্লাহ্র দরবারে সোপর্দ করলাম।” আর নসীহত করলেন, “কখনো যে কোন অবস্থায় মিথ্যা বলবে না। কারণ সত্যবাদিতা মানুষকে বিপদমুক্ত করে ও উন্নতির দিকে নিয়ে যায়।”
ডাকাতদলের কবলে এবং কারামত প্রকাশ
বাগদাদ যাত্রার ঘটনা হুযূর গাউসে পাক নিজেই বর্ণনা করেছেন, “মায়ের নিকট থেকে বিদায় নিয়ে আমি কাফেলার সাথে বাগদাদ অভিমুখে রওনা হলাম। হামদান ছেড়ে অল্প কিছুদূর অগ্রসর হতেই অশ্বারোহী ৬০ জনের সশস্ত্র ডাকাত দল আমাদের কাফেলার উপর চড়াও হলো। কাফেলার মালসামগ্রী ও টাকা-পয়সা সবই ছিনিয়ে নিলো। এরপর আমার দিকে এগিয়ে এসে আমাকে বললো- “হে বালক! তোমার নিকট কিছু আছে কি?” আমি মায়ের উপদেশ মোতাবেক বললাম, “হ্যাঁ, আমার নিকট ৪০টি স্বর্ণমূদ্রা আছে।”
একথা শুনে তার বিশ্বাস হলো না। সে আমাকে ধরে তাদের সর্দারের নিকট নিয়ে গেলো। ডাকাত সর্দার আমাকে কর্কশ ভাষায় বললো, “তোমার নিকট কি আছে? আমি বললাম, “চল্লিশটি দিনার। আমার আম্মাজান দিনারগুলো আমার বগলের নীচে জামার সাথে সেলাই করে দিয়েছেন। আর বলেছেন, আমি যেন কোন অবস্থায় মিথ্যা না বলি। আমি মায়ের আদেশ পালন করেছি।”
গাউসে পাকের মুখ মুবারকে একথা শুনে ডাকাত সর্দারের মনের পট পরিবর্তিত হয়ে গেলো, সে কেঁদে ফেললো। আর বললো, “হায়, এ ছোট বালক তার মায়ের সাথে কৃত ওয়াদা ভঙ্গ করেনি। আর আমরা দীর্ঘদিন যাবৎ আল্লাহর সাথে ওয়াদা ভঙ্গ করে আসছি। আল্লাহর কত বান্দার জান-মাল হনন ও হরণ করেছি।
সাথে সাথে সে তার দলবলসহ গাউসে পাকের পায়ে লুটিয়ে পড়লো এবং তাঁর হাতে খালেস নিয়্যতে তাওবা করে খাঁটি মু’মিনে পরিণত হলো। উল্লেখ্যে, এ ডাকাত সর্দারের নাম আহমদ বদভী এবং সে ও তার দলের এ ষাটজন ছিলো গাউসে পাউসে পাকের প্রথম মুরীদান।
মাদরাসা-এ নেয়ামিয়ায় ভর্তি ও অধ্যয়ন
হুযূর গাউসে পাক ৪০০ মাইল পথ অতিক্রম করে ৪৮৮ হিজরীতে, অর্থাৎ ১৮ বছর বয়সে বাগদাদের বিশ্ববিখ্যাত দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘মাদরাসা-ই নেযামিয়া’য় ভর্তি হন। এখানে দীর্ঘ ৮ বছর কঠোর অধ্যবসায়ের মাধ্যমে তাফসীর,হাদীস, ফিক্বহ, তাসাউফ, আরবী সাহিত্য ইত্যাদি জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন।
পঁচিশ বছর বয়সে তিনি শরীয়তের ১৩ টি শাখায় ও তরীক্বতের বিভিন্ন মক্বামের যাবতীয় জ্ঞানার্জন সমাপ্ত করেন। বলাবাহুল্য,তখন মাদরাসা-ই নেযামিয়ার যুগশ্রেষ্ঠ বরেণ্য মুফাস্সির, মুহাদ্দিস ও শিক্ষকমন্ডলী শিক্ষা দান করতেন। তন্মধ্যে সাহিত্যিক হাম্মাদ ইবনে মুসলিম, মুহাদ্দিস মুহাম্মদ ইবনে হাসান বাক্বেল্লানী ও ফক্বীহ কাযী আবূ সা’ঈদ মাখযূমী আলায়হির রাহমাহ তো শ্রেষ্ঠ ওলীও ছিলেন।
হুযূল গাউসে পাকে তাঁর হাতে বায়’আত গ্রহণ করে ত্বরীক্বতের জ্ঞানর্জন এবং রিয়াযতও আরম্ভ করেন। এভাবে তিনি একদিকে অপ্রতিদ্ব›দ্বী আলিম-ই দ্বীন হয়েছিলেন, অন্যদিকে তরীক্বতের অনেক উচ্চ আসনেও আসীন হন তিনি বলেছেন-
درست العلم حتى صرت قطبا
ونلت السعد من مولى الموالى –
অর্থাৎ- আমি শিক্ষার্জন কিংবা শিক্ষাদান করতে করতে বেলায়তের উচ্চতর স্তর, ‘কুত্বব’-এর মর্যাদায় পৌছে গেছি। আর মহান মুনিব আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে আমি এ সৌভাগ্য লাভ করেছি। [ক্বসীদা-ই গাউসিয়া শরীফ]
কঠোর রিয়াযতে মনোনিবেশ ও গাউসিয়াতে কুবরা অর্জন
তিনি আরো দীর্ঘ পঁচিশ বছর ত্বরীক্বতের কঠোর রিয়ায়তে রত হয়েছিলেন এবং ৫০ বছর বয়সে গিয়ে, ৫২১ হিজরীতে সংসারী হতে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পক্ষ থেকে নির্দেশপ্রাপ্ত হন ও তা পালন করেন।
হুযূও-ই আকরাম এরশাদ করেন, “যুদ্ধের ময়দানে শক্রর সাথে যুদ্ধ করা হচ্ছে ছোটতর জিহাদ। নাফসের সাথে জিহাদ করা হচ্ছে বড় জিহাদ। অর ষড়রিপুর সমষ্টি হচ্ছে নাফ্স। ‘নাফসে আম্মারাহ্’ (মন্দ কাজের নির্দেশাদাতা) হচ্ছে অতি শক্তিশালী। সেটাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য দরকার কঠোর সাধনা। আর যথানিয়মে এ কঠোর সাধনা হচ্ছে ত্বরীক্বতের কাজ। এজন্য দরকার কোন ওলী ও পীরের সান্নিধ্য।
এ করণেই আল্লাহ তা’আলা ক্বোরআনে এরশাদ করেছেন- “ওয়াবতাগূ-ইলায়হিল ওসীলাহ্” (এবং তোমারা তার দিকে ওসীলা বা মাধ্যম তালাশ করো)। এ দুটি আয়াতে কামিল পীরের হাতে বায়’আত গ্রহণের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। [সূত্র- তাফসীরে-ই রুহুল বয়ান]
সুতরাং হুযূর গাউসে পাক সর্বপ্রথম হযরত আবূ সা’ঈদ মাখযূমীর হাতে বায়’আত গ্রহণের মাধ্যমে আল্লাহর এ নির্দেশ পালন করলেন। তারপর থেকে শুরু করলেন কঠোর রিয়াযত বা সাধনা।